Sunday, May 12, 2019

শেকড়


তিন কুঠরি ঘরটার ঠিক পূর্ব দিকে এক পাল্লার একটা জানালা রোজ খোলা থাকে, ওটার দর্শক বলতে বছর পঁয়ষট্টির একজন সাদা মাথার, লম্বা চুলের, রঙিন কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলা| দুপুর পোহালেই তিনি জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো বট গাছটার দিকে কিছু আশা  নিয়ে দেখতে থাকেন। দেখতে দেখতে হয়তো কিছু ভাবেন, কে জানে কী ভাবতেন তিনি! একদিন আমার NGO থেকে অনুমতি নিয়ে আমি তাঁর ঘরে ঢুকলাম, অবশ্যই কিছু জানার জন্য। সুন্দর একটা চেয়ারে বসতে দিলেন তিনি, বসেই এক গ্লাস জলও দিলেন|আমি শুরু করলাম আমার জিজ্ঞাসার কথাগুলো| জানতে চাইলাম তাঁর পরিচয়, উত্তরে বললেন, " আমি কৃষ্ণেন্দুর মা, আমার ছেলে এখন জর্জিয়াতে এক বিশাল  কোম্পানিতে চাকরি করে, হয়ে গেলো প্রায় এগারো বছর"। বলেই তিনি চুপ,আবার আশাতীত চোখে দেখতে থাকলেন ওই বট গাছটাকে|
        
                  এবার বেশ স্বাভাবিকভাবেই শুরু হলো আমাদের কথোপকথন---

আমি:: আচ্ছা, আমি তাহলে আপনাকে মাসিমা বলেই ডাকি ?

মাসিমা:: হ্যাঁ| এতে আবার জিজ্ঞস করার কি আছে !

আমি:: আচ্ছা মাসিমা আপনি রোজ ওই বট গাছটার দিকে তাকিয়ে কি ভাবেন ?
মাসিমা:: আমি শুধু দেখি, দেখে কিছু শিক্ষা নিই, তুমিও যদি খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য কারো তুমিও ঠিক বুঝতে পারবে| যৌবনে আছো তো তাই এসবে তোমার চক্ষুপাত বা জিজ্ঞাসার কোনো আখাঙ্কা নেই, একটু বসয়সে চুলগুলো কপাল থেকে মাঝ মাথায় গেলেই তুমিও হয়তো ভাবে এরকমই কোনো কিছু স্থির জিনিসের দিকে তাকিয়েই| মিল খোঁজার  চেষ্টা করবে তোমার জীবনের সমান্তরালে  চলতে  থাকা  অন্য আরেকটা জীবনের গতিপথের মোড়গুলো  কোথায় গিয়ে ঠোক্কর খায় |

আমি:: কিরকম ?
মাসিমা:: দেখো এই গাছটার দিকে চেয়ে, হয়তো ওটার পৃথিবীতে আগমন আমার আসার আগেই হয়েছে, ওটার প্রাণের দামও  কিন্তু  আমার মতোই খুব দামি, ওটাও ভাবে তার থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিটা ঝুরির জন্য, প্রতিটা পাতার জন্য, সে সবুজ পাতায় হোক বা পড়ে যাওয়া ওই হলদে মাটির বর্ণের পাতায় হোক, ওটা কিন্তু ওদের কে আগলে রাখার জন্যই নিজের শেকড় ধরে, মাটি কামড়ে ধুয়ে যাওয়া ভূমিক্ষয়ের ওপরেও দাঁড়িয়ে থাকে |

আমি:: কিছুই বুঝলাম না ক্ষণ আপনার কথা, একটু খুলে বলুন না| ছোট মাথা, ছোট বয়স, চিন্তার আকাশে শুধু গোলাপের তারারায় জ্বল-জ্বল করে |
মাসিমা:: ঈষৎ হেসে, মাসিমা আবার বলতে শুরু করলেন | আমার মতোই ওটাও ওই ঝুরি, পাতাগুলোর মা, ওটার থেকেই ওদের জন্ম| ওদের জন্য একটা শেকড় আঁকড়েই ওটা হয়তো এখনও ক্লোরোফিলে নিজেকে রোজ রাঙানোর চেষ্টা করে|আমার ক্ষেত্রেও, আমিও রোজ কৃষ্ণেন্দুর জন্য নিজেকে এখনো সেই বত্রিশ বছরে ফিরিয়ে নিয়ে যায় | রোজ রোজ যেন মনে পড়ে এই তো সেদিনই আমার সামনে থেকে গেলো সে পড়তে বাইরের রাজ্যে, আমাকে একটা নতুন ঘরে সাজাবে বলে, আমার কিন্তু কোনো উচ্ছাস বা উচ্চাশা ছিল না, কারণ আমি তো মা, আমি শুধু চাইতাম যেন শুধু নিজের পায়ের মাটিটুকু আমার মতোই কোনো শক্ত শেকড়ে বাঁধতে পারে| যখন আমার থেকে দূরে গেলো, আমাকে বলে গেছিলো, ফিরে এসে দেব তোমার অট্টালিকার ছাদ | আজ এগারো বছরে  আমার সম্বল শুধু এই তিনকুঠরী ঘরের সাথে কিছু আমার মতোই আরও অনেক কৃষ্ণেনেদুর মা-এর দল |


আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে, নিজের মোবাইল থেকে একটা কোনো কিছু তাড়ার খোঁজ করতে লাগলাম, আমি কোনো প্রশ্ন খুঁজে পেলাম না, কোনো কিছু বলার আগেই, মাসিমা নিজের থেকেই শুরু করলেন তার পরের কথা গুলো

এবার একটু নরম সুরে---

মাসিমা:: আমি নিজেও স্কুল টিচার ছিলাম, কৃশকে তার ছোট থেকেই কোনো রকম আঁচড় না লাগতে দিয়েই হিক ওই বট গাছটার মতোই আগলে রাখতাম | প্রতিদিনের পড়া থেকে শুরু করে, স্কুল ফাইনালের পরীক্ষা পর্যন্ত রাত জেগে তৈরী করে দিতাম ওকে, কিন্তু আজ দেখো চাকরির কাজে বাইরে গেলো আমাকে ছেড়ে, এগারো বছরে মনে রেখে সতেরো বার ফোন করেছে বটে,কিন্তু আজকে তুমি  যে চেয়ারটায়  বসে আছো ওটা কিন্তু কোনো দিন কৃষ্ণেন্দুর গায়ের গন্ধে ভরেনি| সত্যি বলতে,আমি শুধু ওই গাছটার দিকে তাকিয়ে নিজের মধ্যে ওর মতোই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার ছেলের জন্যই অপেক্ষায় কাটাই, আর ভাবি যেন ওর আগামী দিনের ঝুরি পাতা গুলো যেন ওকে ছেড়ে গেলেও নিজেদের কে মূল শেকড় থেকে না বিচ্ছিন্ন করে|

মাসিমার মুখে শেষ দুটো লাইন শোনার পরেই,আমার মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত কান্নার স্রোতের ঢল বাইরে বয়তে চেয়েও পারছে না বয়তে| আমি খানিক ক্ষণ চুপ করে বসে থেকে দু- গ্লাস জল খেলাম,বিকেল তখন প্রায় হবে হবে, আমার NGO-এর নির্ধারিত সময়টাও প্রায় শেষের মুখে, এবার আমার ফিরে আসার পালা, আসার আগে শুধু দু-পা ছুঁয়ে প্রণাম করে, পরে কবে আসবো সেটা জেনেই বেরিয়ে এলাম|


এখনো যাওয়া আসা হয়, এখনো গল্প গুলো ঠিক মাসিমার কথা মতোই  হয়,কিন্তু প্রথম দিনের থেকে আজ-কালের কথোপকথনে একটাই ফারাক, প্রথম দিনটা ছিল আমার কর্তব্যের খাতিরে যাওয়া,আর এখন যাওয়া হয় কোনো কিছুর টানে,ঠিক যেন অন্য কোনো গাছের কোঠরে অন্য গাছের জন্ম নেওয়ার মতোই|

2 comments: