Tuesday, April 16, 2019

প্রজাপতি

আমার দরকার একমুঠো ইটের গুঁড়ো,দেহে কাদামাখা জামার আবরণ। গ্রীষ্মের দুপুর যখন চলছেই এখন--তাই কোনো ছোট আমগাছের হাত, যা  বাড়াবে আমার দিকে,হাত ধরে থাকবো বসে,দুপুর কাটাবো আমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে। বিকেল যখন আসবে তখন বয়সের ওজনকে একটু কমানোর জন্যই বৃষ্টিকে চাই,ধুইয়ে দেবে আমায়,সারা গায়ে মাখবো ফেলে আসা সব বাদামি,লাল রঙের কাদা মাটি গুলো,ইচ্ছেরা  বেয়াড়া হবেই জানি,এখনো শৈশব বেঁচে আছেই। 
  
   কিন্তু প্রশ্ন জাগে মাঝে মাঝে  যে, যেগুলো আমি পেতাম তখন,এখন পাই না কেন?

    সেসব ভাবলেই মনে হয় এটা বোধহয় বৃষ্টির দোষ,আবার অনেক সময় মনে হয় দোষ দিয়েই কি হবে এখন তো নিজেকে আড়ালে রাখি,শীততাপের মধ্যে সাদা চামড়ায় আবরণে ঢাকি, মনের ইচ্ছে গুলোকে কাজের মেয়াদে লুকোই,আর তার থেকে বেশি হলে টিভির মধ্যে ঢুকে পড়ি কোনো পর্যটকের মতো| কি বেয়াদপ সবাই,এখন তো আর আগের মতো আইসক্রিমের লোকটাও আমার পাশের ফ্ল্যাটের গলি দিয়ে ডাক দিয়ে যায় না! শুঁয়োপোকার মতো নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি যেন একটা রেশম গুটির মধ্যে,পরিবর্তনের নামে আরামের আদর চেয়ে|

    আমাকে কেও যদি দিয়ে যেতে পারতো একটু রামধনুর রং,সাতটা রঙ না হলেও চলবে,হাতে গুনে দু-একটাই দিয়ে যাও,অনেক দিন রং মিলান্তি খেলার চলে দিগন্তের ধারে গিয়ে পশ্চিমি পাঁচিলে ডাক পাড়িনি,খুব ইচ্ছে হয় জানো, কিন্তু আমার পা বেঁধে রেখেছে এক অবচেতন শিকলের বাঁধন,খুলতেই পারছিনা, চাবিকাঠিটা হারিয়ে এসেছি এগারো বছর আগেই| এখন শুধু ছুটে বেড়াই,বড়ো হওয়ার তাগিদে ব্যস্ততাকে পিঠে নিয়ে বয়ে বেড়াই, কাঁধের দু-পাশে কত ক্ষতের দাগ যেগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারে না কেও,শুধু বুঝতে পারি আমি। উড়ান দিতে আমিও চেয়েছিলাম কিন্তু উড়ানের নাম নিয়ে যে হাওয়ার স্রোতে নিজেকে বইয়েছিলাম সেটার নিজেরই কোনো অন্তমিল নেই| আমি এখন প্রায় হারাতে বসেছি রামধনুর রঙের পাতাগুলো, একটা একটা করে যেন পাতাগুলো ঝরে পড়ছে, মুখ ঢাকছে পুব-আকাশের পাদদেশের উল্টো উপত্যকায়| কোনো নতুন সাজ নেই, আছে কিছু জোকার মুখো অট্টহাসির দল, কানে রক্ত ঝরে, চোখে বিষণ্ণ নামে অবিরাম|

   যদি কেও আমায় এক আঁজলা জল দিতে খুব আরাম পেতাম আমি, কিন্তু কোনো রকম ফ্রিজের থেকে না, আমার ফেলে আসা পাড়াতে যেখানে টিউবয়েলটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে তার পথিকের অপেক্ষায়, তার মুখের থেকে একটু আরামের জল আমার নামে  ধার করে নিয়ে আসতে পারো। আমি ধার মিটিয়ে দেব তার, যখনি সময় পাবো, আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবো, কথা বলবো না হয় তার মতো করেই,যেমনটা করতাম আগে,সবাই খেয়ালি খেলার শেষে চার-পাঁচটা তৃষ্ঞার্ত হাত তাকে ছুঁয়ে তার একাকিত্বকে দূর করে জল নিতাম চেয়ে| এখন আমি না হয় আমার দুটো হাত দিয়েই তার একাকিত্বকে মেটাবো |

আবার সেই একটা জায়গাতে গিয়েই ধাক্কা খাই,পারবো তো সত্যি? যদি না পারি তাহলে নিজেকে উত্তরে কি বলবো?

  ইটগুঁড়ো,কাঠের ভেলা,পাথর ঘষা কাঠগুড়ি,কথার নামে কাদা ছোড়াছুড়ি,অল্প বিস্তর ধুলোর বিছানাতে বিকেলে লুটোপুটি, সব কিছুই হয়তো আছে এখনো শুধু বদলে  গেছে তাদের  রূপ,আফশোষ  বলতে একটাই যদি তারা এখনো থেকেই থাকে তাহলে আমার কাছে নেই কেন তারা?

       উত্তর খোঁজা ছেড়ে দিয়েছি সেদিন থেকেই যেদিন থেকে নিজেকে শুঁয়োপোকার মতো গোটানো শুরু করেছি  ওই আরামের গুটিতে, যেখানে চেয়েছিলাম কিছু বিবর্তন আসুক আমার মনে, প্রাণে। কাজ খোঁজার নামে নিজেকে এখনো ভাসিয়ে যাচ্ছি ব্যস্ততার জলসাঘরে

    একবার শুধু একবার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে আমার,সেই পুরোনো গাছের ডালে পা দোলানোর নামে,পাতার হাতে নিজেকে নিতাম মুড়ে,ডাক পড়তো কিছু ঘুঘুর,শিস শুনতাম দোয়েলের,কাঠঠোকরার ঠক ঠক বায়না শুনে আরেকবার  ঘরে ফিরতাম ধুলোতে মুখ মুছে 

    শুধু একবার হ্যাঁ শুধু একবার আঙ্গুল কেটে বোঝাতাম মনকে ওটা খেলতে গিয়েই লেগেছে আমার বুকে |



 

Tuesday, April 2, 2019

হ্যালো লাইফ

সময় শুধু মাত্র বর্তমান,পরিবর্তনগুলো কেবল কিছু ডাকবাক্স,যাদের ডাকপিয়নেরা কাঁটার ঘূর্ণনের সাথে সাথে ঠিকানা বদলে বদলে নানারকমের চিঠি পাঠিয়ে যায়,কিছু চিঠি বয়ে আনে সুখ, কিছু চিঠি বয়ে আনে নতুন করে জেগে ওঠার জন্য উচ্ছাস,আবার কতকগুলো চিঠির খামে লেগে থাকে জীবনের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের গল্প|শুধু বেছে নিতে হয় নিজের মতো খামে ভরা চিঠি, কারণ সব কিছুতে আমাকে একটাই জিনিস এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে,"পরিবর্তন"|এই একটা শব্দই বদলে দিয়েছে আমার জীবনের দর্শনের খোলা মাঠের আবহাওয়াকে, যেখানে ঝড়-ঝাপ্টা থেকে ছোট ছোট ঘাসফুলের মাথা দোলানোর সুর,সব কিছুই আমাকে প্রভাবিত করে আজকাল|

আজ এসব লেখার কারণ খুঁজতে গেলে,আমাকে ফিরে তাকাতে হয়,এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমি জীবন খুঁজে শ্লোগান ওড়াচ্ছি তার থেকে ঠিক চার বছর আগে মুম্বাইয়ের ক্যান্সার হসপিটালে|কালো পর্দায় ঘেরা, একটা ভিজিটিং রুমে আমার সাথে কেবল সময় গুনতো সামনের চেয়ারে বসে থাকা ডাক্তারবাবু, ওই ঘন্টা দুয়েকের কথাতেই যেন একটু একটু করে প্রাণ ফেরত দিতো আমার হৃদ্স্পন্দনে|যদিও দোষের কথা বলতে গেলে আমার নিজের উচ্ছশৃক্ষল লাইফস্টাইলটাই চোখের বারান্দায় বারবার ঘুরপাক খায়|সদ্য যৌবনের ঢেউয়ে ভাসতে থাকা পালতোলা নৌকোর মতোই আমিও ভেসেছিলাম সিগেরেট,আলকোহলের বানভাঙা হওয়ার গতির সাথে,নিজের গন্তব্যকে ভুলে গিয়ে শুধু ভেসে গিয়েছিলাম একটা বেয়াড়া ঢেউয়ের সাথে যেটা তখন হসপিটালের চরে এসে ভেঙেছিল,আর আমি মুখথুবড়ে পড়েছিলাম রক্ত বমির বালির পাঁচিলে|ছোট ছোট ভুলের দানাগুলো দেখি বিশাল ভুলের পাহাড় হয়ে মাথাচাড়া মুখ তুলেছে আমার লিভারের পাদদেশে|প্রতিবার চেকআপ করে বাড়ি ফিরে এসে শুধু একটাই প্রশ্ন তুলে রাখা থাকতো,"কেন"? আমার নিজের লাইফস্টাইলের জন্য বাড়ির লোক কেন ভোগ করবে, তখন ভেবেছিলাম এবার এটাকে এখানেই শেষ করা দরকার, এভাবে কেমোর যন্ত্রনা নিয়ে বেঁচে থাকার থেকে, পুরোপুরি ভাবে যন্ত্রণাকে বিদায় জানানো ভালো|

কিন্তু না, সেরকমটা হলো আর কোথায়|য্খন আমি দেখতাম আমার পড়ার বই,পাশেই পড়ে থাকা ডায়েরি পাতাতে যেখানে আমার সব ইচ্ছেদের বীজ বুনতাম একা একাই, কম্পিউটারে গুগল সার্চে হাজার রকমের ফিকির আমার জন্য এখনো অপেক্ষায় দিন গুনছে, তখনই হয়তো আমার কাছে আবার একটা নতুন করে শুরুর জন্য হাতছানি দিচ্ছিলো ওপারের সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আজকের এই দিনগুলো|যদিও রাস্তা মোটেই সহজ ছিল না,সব রকমের খাবার ব্যতিরেকে কেবল মাত্র কিছু সেদ্ধ খাবারের মেনু তুলে রাখা থাকতো আমার জন্য,উচ্ছশৃঙ্খলতার সমস্ত কারণ গুলোকে আমি জানিয়েছিলাম বিদায়,ওদের জন্য আজও আমার ঘরের দরজায় লালাবাতি জ্বলে,কারণ আমি আজ ভালো আছি|

শারীরিক কষ্টের বাঁধন মাঝে মাঝে এতটাই দৃঢ় হয়ে যেত যে,কান্নার জন্যও মুখ থেকে কোনো আওয়াজ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বেরত না সেই সময়,কিন্তু সব কিছুকে পেছনে ফেলে আমাকে যে এগিয়ে যেতে হবে সেটার প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম নিজেকে|সময় শুধু বদলে গেছে তার সাথে মরেও গেছে আমার ভুলের জন্য গজিয়ে ওঠা একটা রোগের গাছ যেটাকে মারার জন্য কোনো বিষ দিতে হয়নি আমাকে, আমাকে শুধু দিতে হয়েছে নিজের মনকে আত্মশক্তির ভরসা|আমি ভরসা পেতাম শুধু একটা কথা ভেবেই, যে রক্ত যতদিন বয়েছে শরীরে,স্পন্দন যতদিন মিশে আছে সব ইচ্ছেদের কণাতে, ততদিন না হয় বাদ-  দিলাম ওই রোগের অতীতকে|আজ সেই নিজের শক্ত মনের শিকলের জোরেই নিজের পাঁজরে বেঁধে রাখতে পেরেছি আমার হাসি, আমার সুখ, আমার নতুন করে পাওয়া আজকের জীবনকে, তার সাথে নতুন করে জীবনে আসা প্রেমের আবেগ কেও|

আজকে যখন আমি পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখি আমার জীবনের ছায়াছবিতে ওই চারটা দৃশ্য কালো ঝিলমিলে পর্দাতে ঢাকা,তাই আজ আর ওই কালো পর্দাকে সরিয়ে দেখতেও যায় না সেইসব পর্বগুলোকে|আমি আবার হাসতে শিখেছি, আঙ্গুল চলছে শব্দদের সাজানোর খেলায়, শত খেয়াল আমাকে তাড়া দেয় তাদেরকে গল্পে প্রাণ দেওয়ার তাড়াতে, আর আমিও জীবনকে তাড়া দিতে থাকি তাদেরকে নতুন নতুন অনুভূতিতে দোলানোর তাড়নায় | যন্ত্রনা,ওটা না হয় কালো পর্দার পেছনেই ঢাকা থাক আরও কিছু বছরের জন্য, কারণ আমি যে চিঠিটা পেয়েছিলাম পরিবর্তনের ডাকবাক্স থেকে সেটাতে লেখাছিল,"জীবন শুধু একটা নাটকের মঞ্চ কাওকে মরতে হয় এই মঞ্চে তার চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, আবার কেও বেঁচে থাকে নাটকের পরিচালক হয়ে,নতুন একটা নাটক লেখার মঞ্চ খুঁজে|"

তাই আমি নিজের চরিত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছি আজ পরিচালকের কলম ধরে||