Tuesday, February 26, 2019

মন্বন্তর

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর পড়েছিলাম ছোটবেলায়, বইয়ের কতকগুলো পাতা উল্টেই, ব্যাপারটা শুধুই পড়ে নেওয়ার মতোই ছিল তখন আমার কাছে,সেভাবেও নাড়া দেয়নি আমার অন্তর্যামী আরেকটা মানুষকে, কারণটা সত্যি স্বাভাবিক ওই বয়সে বইয়ের পাতার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজতে যাওয়ার জন্য আমার নিউরোনগুলো সেভাবে বিকশিত হয়নি | মন্বন্তরের নিয়ে এখন আরেকবার পড়লে যেন আমার শিরদাঁড়ায় কেও সুক্ষ সুঁচ নিয়ে আঘাত করার মতোই চিন-চিন করে ওঠে সারা শরীর, একটা যেন অজানা ব্যাথা ক্ষনিকের ব্যবধানেই আমাকে গিলে ফেলে | যেটা হয়তো কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হবে না, তাই লেখার চেষ্টাটাও বৃথা বলে মনে হয় অনেক সময় |প্রতিটা যুগেই কিছু না কিছু ব্যাধি আমাদের সমাজে তাদের মতো করে একটা বিপ্লব নিয়ে হাজির হয়, যদিও কারণের মুলে খুঁজে দেখতে গেলে হয়তো আমার তোমার মতোই কোনো না কোনো পাজরে ঝোলানো মাংসের মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যাবে | কখন মানুষ খাবার খুঁজে নিজেদের মধ্যে মারপিট করে বেঁচে ছিল,কখনো আবার মানুষ নিজেদের অস্তিত্বের প্রমান দেওয়ার জন্য ধর্ম, জাতি নিয়ে লড়াই করে পৃথিবীতে রক্ত বইয়েছিলো | সব জায়গাতে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মিল একটাই কিছু মানুষ | যাদের নিজেদের স্বার্থ, নিজেদের দমফ, নিজেদের অহংকার জারি করার জন্য কিছু মানুষ ভুক্তভোগী হয়েছে প্রতিটা ক্ষেত্রেই |

সেই যুগের কথা এলে আমার এগুলো মেনে নিতে খুব একটা কষ্ট হয় না, কারণ তখন হয়তো শিক্ষার অহংকারটা খুব কম লোকের কাছেই মাথা নিচু করে থাকতো, খুব কম জনের বাড়িতেই শিক্ষার দর্শন পাওয়া যেত, খুব বেশি হলে ওটা বিলেতে গিয়ে খুঁজতে হতো, কিছু কালো কোর্ট, প্যান্ট পড়া সাহেবদের দালান বাড়ির পাচিলের সামনে |

যুগের পরিবর্তন এলো বটে, মানুষ নিজেদের মনুষত্বকে ভুলে এখন বিচার সভায় বসে বিচার করে কে ছেলে, কে মেয়ে, কার ওপর শোষণ করা যায় নির্দ্বিধায় | কার সমাজে কতটুকু অধিকার | আশ্চর্য একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমাকে ভাবতে হবে যে ছেলের অধিকার বেশি নাকি মেয়ের ? রাত্রিতে কে বেরোবে বাড়ির বাইরে, আর কে দেখবে রাতের চাঁদ বাড়ির ছাঁদে বসে? কার শরীরে কতটুকু জামা থাকলে তাকে বলা হবে সভ্য বা অসভ্য ? কে কিভাবে হাঁটবে রাস্তায়, কে কখন কোনো পীঠস্থানে যেতে পারবে তার শ্রদ্ধা নিবেদনে ? সত্যিই কি আমরা সমাজের এগোনোর সাথে সাথে নিজেদের কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি ? নাকি এখন নিজেদের মনুষত্ব ভুলে গুনতে বসেছি কার ওপর কখন করবো শোষণ, কার ওপর মেটাবো নিজের কামের তৃষ্ণা ? নাকি ধর্ম,জাতির দোহাই দিয়ে আমরা এখন সেই আদিম যুগের মতো পশুর মতো নিজেদের কে মেরে খাবার প্রবণতা রাখবো ? সমাজ আমার সভ্য হলো না গো | শিক্ষার দরকার কেও বুঝলো না গো |

এখন তো আবার মন্তরের নতুন একটা নাম দিয়েছি আমি ""রাজনীতি"" | কি হয় জানো, যখনি আমি সাতসকালে খবরের কাগজটা আমার পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে খুলে দেখি, শুধু দেখতে পায় কতকগুলো কচি -কচি প্রাণ কিছু নৃশংস পশুর হাতে সমর্পন করছে নিজেদের স্পন্দন | খুব বাজে লাগে জানো যখন দেখি আমাদের সমাজে কিছু মানুষ মন্বন্তরে সামিল হয়ে নিজেদের আশা, পিপাসা মেটানোর জন্য কিছু ফুটফুটে প্রাণকে কেড়ে নেয় দিন দিন তাদের মায়ের কোল থেকে | বিশ্বাস করো আমি নিজেই আজ সন্ত্রস্ত, নিজেই ভীতুপ্রায়, নিজেক এতটাই অসহায় মনে যে আমি আজ কাল ওই প্রাণ গুলোর দিকে তাকিয়ে হাঁটতে  গেলেও সোজা রাস্তায় হোঁচট খেয়ে যায় |


একবিংশতে দাঁড়িয়ে যদি আমাকে প্রতিটা খুনের পরে শুনতে হয় তার জাতি, তার ধর্ম, বর্ণ, গায়ের কাপড় নিয়ে, তাহলে আমাকে ক্ষমা করো | কারণ আমি এটুকুই বুঝি আমার ছোট্ট মাথার চিন্তা থেকে যে মনুষত্ব সবার আগে |

ক্ষোভের কথা বলতে গেলে আমি বলতেই পারি ," কিসের রাম, কিসের হিন্দুত্ব, কিসের প্রফেট, কিসের মুসলমান, কিসের ক্রাইস্ট, কিসের ক্রিস্টান, কিসের বুদ্ধ, কিসের বৌদ্ধ, কিসের আমি শিখ? যে ধর্ম আমাদের কে মনুষত্ব থেকে দূরে নিয়ে যায়, যে বিশ্বাস আমাকে মানুষ বলতে ঘৃণা বোধ করায়,যে বিশ্বাসে কতকগুলো মানুষ ঘৃণ্যতম কাজে নিজেদের লিপ্ত করে দিন দিন, আমি মানি না সেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী কোনো কাউকেই |"" আজকের কথা বলতে গেলে নিজের কলমে অক্ষরের জায়গায় কিছু সাত, আট, দশ বছরের মেয়ের আর্তনাদ বেরিয়ে আসে যাদের শব্দের তীক্ষনটা এতটাই বেশি যে কলম ধরে আবার তুলে রেখে দিতে হয় দোয়াতে | তাদের প্রতিটা আঁচড়ের দাগ এতটাই স্পষ্ট যে, ওই সকল দুস্কর্মীদের  দেহের মধ্যে দুশো ছটা হাড় আছেতো আদৌ সেটা নিয়েই চিন্তা হয় | যখনি কেও আমাকে সমাজের নিয়ম নিয়ে কিছু বলতে আসে তখন তাদেরকে আমি একটা কথাই বলি আজকাল,""কিসের সমাজ, কিসের আইন, কিছু ঋণের দস্তাবেজ, কিছু পুঁথির মারামারি, নিজের কাছে নিজেই যখন লজ্জিত, এই সমাজকে, জানাই আমার শতকোটি ধিক্কারের বাড়ি |""

যখন দেখি রাস্তায় মানুষ নেমেছে, নাকি সমাজে কিছু পরিবর্তন আনবে তারা, কিছু মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে, তখন আমি সমর্থন করিও বা হয়তো তাদের, কিন্তু তারা এটাই ভুলে গেছে যে আবার ফিরে এসেছে " মন্বন্তর " , তাই আমি এখন মোমবাতির দোকানে গিয়ে জমায় না ভিড়; আমি বরং দাঁড়িয়ে খুঁজি কোনো বইয়ের দোকানে সামাজিক নীতির সুগন্ধি পাপড়ি | মোমবাতির আলো জ্বালানোর থেকে সমাজে জ্ঞানের আলো আজ খুব দরকারি |

4 comments: